পড়ুয়া হবার গল্প

 বই পড়া শুরুর তেমন গল্প না থাকলেও কিছু কারণ আছে। কারণগুলো সব একএক করে বলে যাচ্ছি।


কারণ ১-

টিভিতে নিউজ রিডারদের দেখে ছোটবেলায় ইচ্ছে করতো ‘নিউজ রিড’ করার। তাই আমি পড়ার যেটাই পেতাম সেটাই নিউজ রিডিং এর মতো সুর-তাল মিলিয়ে পড়তে শুরু করে দিতাম। একটা সময় দেখলাম, পত্রিকার বোরিং জিনিসপত্র পড়তে ভালো লাগছে না। তাই পাঠ্যবই পড়া শুরু করে দিলাম। বিছানায় সেট হয়ে বসতাম সামনে দূতও বালিশ হচ্ছে টেবিল। আর শুরু হলো “এখন দেখবেন বিশেষ খবর; খবরে থাকছে অমুক প্রবন্ধটি। লিখেছেন প্রমথ চৌধুরী ...”

কারণ ২-

রিডিং পড়া শুরু হয়েছিলো ক্লাস ওয়ান টুতেই। বছরের প্রথম দিনে স্কুল থেকে তখন বই পেতাম না। কিন্তু যেদিন নতুন বই পেতাম সেদিন ছিলো আমার ঈদ। বাসায় এসেই সব বই শুধু একবার সম্পূর্ন রিডিং পড়ার (মানে খবর পড়ার) সংকল্প নিয়ে বসে পড়তাম। আর শুরু করতাম সামাজিক বিজ্ঞান বই দিয়ে। (উল্লেখ্য মজার বস্তু আমি সবার শেষে খাই। আর সবচেয়ে বিরক্তিরটা আগে)

বলাই বাহুল্য একসময় বিরক্ত হয়ে সমাজ বই রেখে দিতেই হতো। সমাজ কাকে বলে, পরিবার কাকে বলে আর গৃহ কি – এসব পড়তে পড়তে একসময় সত্যিই লো-প্রেশার আক্রমণ করে বসতো ঐ বয়সেই। মাথা ঘুরাতো, বমি পেতো। তাই বাধ্য হয়ে সমাজ ছেড়ে ধরতে হতো “আমার বই – ২য়/৩য় ভাগ”। এবারও বলাই বাহুল্য প্রথম প্রবন্ধ “আমাদের দেশ”ই যথেষ্ট ছিলো প্রেশার আর মাথা ঘুরানো স্বাভাবিক করে দিতে।

সুতরাং, আমার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমার শারীরিক সুস্থ্যতা। গল্প-কবিতা কোন একটা কারণে আমাকে সুস্থ্য করে তুলতো।

কারণ ৩-

তখনো বই, মানে পাঠ্যবই আর পিঙ্কি/চাচা চৌধুরীর বাইরে কোন বই পড়া হয়ে উঠলো না। একবার ক্লাস ফাইনালের শেষে কাজিনের বাসা থেকে সব কমিকস নিয়ে এলাম। সাথে আনলাম সেরা রূপকথার গল্প। ওটাই ছিলো মূলত প্রথম বাইরের বই। এরপরের বছর স্কুলে বইমেলায় বই কিনতে শখ হলো। আম্মুর কাছে অনেক চেয়ে ৫০টাকা পেলাম। আর টিফিন থেকে আরও ১০। মোট ৬০টাকায় ঠাকুরমার ঝুলি কিনার সামর্থ্য হয়ে গেলো। এটাই প্রথম কেনা বই। মেলা ছিলো তিনদিন। ২য় দিনে আমার বই কিনার আগ্রহ দেখে আমার বন্ধু চাঁদনী ৩য় দিন কিনে দিলো ইশপের গল্প সমগ্র – আমার প্রথম পাওয়া বই উপহার। সে বছরই একটা কন্টেস্টে জিতলাম সাই-ফাই ‘বেজি’ আর কবিতা সংকলন ‘পুনশ্চ’ – প্রথম বই জেতা। এগুলো ক্লাস ফাইভ সিক্সের কথা।

কারণ ৪-

জেদ আর বিদ্রোহ। বড়রা যেটা বলবে আমি ঠিক তার উল্টোটাই করবো – এমন ছিলাম। আব্বু-আম্মু বলবে পড়ার বই পড়ো, বাইরের বই পড়বে না। আমি তাই পড়ার বইটা হয়তো ধরতে যাচ্ছিলাম পড়বো বলেই। কিন্তু না ধরে নিয়ে নিলাম গর্ভধারিনী। ক্লাস ৮ এর ঘটনা সেটা। বইটার আর মাত্র ডজনখানেক পৃষ্ঠা বাকি ছিলো পড়ার। তখনই হাতে ঐ বইটা দেখে আব্বু টেনে নিয়ে ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিলো। পাঁচ তলা থেকে সোজা নিচ তলায় বইটার ধড়াম শব্দটা এখনো মনে আছে। জেদ উঠলো। টিফিনের টাকা জমিয়েছিলাম উত্তরাধিকার কিনতে। সেটা দিয়েই পরদিনই আবার গর্ভধারিনী কিনে আনলাম; বাকি দশ পেইজ পড়লাম। এরপর টেবিলে সাজিয়েও রাখলাম। উত্তরাধিকার এরপর কিনতে আরো কয়েকমাস লেগে গিয়েছিলো যদিও। :( যাইহোক, টিফিনের টাকায় না খেয়ে জমিয়ে বই কিনতাম।

এরপর লাইব্রেরি ক্লাসে পাওয়া বই আর বিসাকে-এর বই দিয়েই নিয়ত বই পড়া চলেছে। কলকাতার বই বেশি ভালো লাগতো তখন। পটার সিরিজ কিনতে অনেক মাস টাকা জমাতে হয়েছে। পটার সিরিজ পড়ে ফেলার পর নন-ফিকশনে আগ্রহ হয়েছিলো হারমিওনিকে দেখে। এরপর নন-ফিকশন।

কারণ ৫-

গোয়েন্দা বই বেশি পড়া হতো। একটা সময় ডিটেক্টিভ হতে চাইতাম। কলেজে উঠে এনডিসির পাশের গলিতে (গলির নাম ভুলে গেছি) কোচিং করেছিলাম দু’মাস। তখন আসা যাওয়া হতো রাজারবাগের ডিটেকটিভ স্কুলের পাশ দিয়ে। চুনকাম করা সরকারি বিল্ডিংটা মোহময় আকর্ষণ নিয়ে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। আর আমি তার দিকে। -_- যাইহোক, গোয়েন্দা হতে চাইলেই তো আর হয়না। অনেক কিছু অবসার্ভ করতে হয়। মানুষকে চিনতে-বুঝতে হয় – বুঝলে? – নিজেকে বোঝালাম। একসময় বিভিন্ন বই আর উপন্যাস পড়ে পড়েই মানুষ চেনার চেষ্টা করতাম। অন্তত তখনকার আমির জন্য এটাই ছিলো মানুষকে (বাইরের মানুষ) চেনার একমাত্র উপায়। বুঝতে চাইতাম ধ্রুব এমন কেন, কিংবা অনিমেষের সমস্যাটা কি? আর অর্ক এরকম কেন করলো ঐ মেয়েটার সামনে? কিংবা ঐ নারী কেন চাকু দিলো অর্ককে। গল্প উপন্যাস আমার কাছে তখন আর শুধু ঘটনা না, অনেক প্রশ্নের সমাহার; অন্যের অভিজ্ঞতা আর ভাবনাকে নিজের ভেতর প্রসেস করার অল্পসল্প প্রয়াস; মানুষকে জানার মাধ্যম।

শেষ কারণ –

এখন বলা যাবে না। আরেকটা আর্টিক্যাল লাগবে সেটা বলতে।

Comments